Saturday, October 24, 2015

প্রতিবেশী

 

** রহস্যপত্রিকায় প্রকাশের জন্য মনোনীত। **

 
 
রচনাকালঃ ২৪শে অক্টোবর, ২০১৫

Friday, October 9, 2015

লিফট সমাচার

 

এক.

নিচে যাবো। লিফটে নিচে যাবার কল বাটনে চাপ দিয়ে অপেক্ষা করছি। লিফট আটে এসে থামলো। দরজা খোলার পর ঢুকতে গিয়ে দেখি ভেতরে মধ্যবয়স্ক একজন লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল গুতাচ্ছেন। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। হুজুর টাইপ দাড়ি নয়। ফ্রেঞ্চ স্টাইলে ছাঁটা দাড়ি। দেখলে বোঝা যায়, নিয়মিত সেলুনে গিয়ে দাড়ির পরিচর্যা করান।
 
উনি ভেতর থেকে বের হচ্ছেন না। আমি ভাবলাম, উনি ওপরতলায় যাবেন।
 
“উপরে যাচ্ছেন?”
 
“লিফট তো উপরেই যাচ্ছে।” উনার উদাসী জবাব।
 
“আচ্ছা, ঠিক আছে।” আমি পেছনে সরে এলাম।
 
লিফট দশতলা ঘুরে আবার আটে এসে থামলো। দরজা খোলার ঠিক আগমুহূর্তে আমি দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে ‘খুল যা সিম সিম’ টাইপ একটা ভঙ্গি করলাম। আশেপাশে কেউ না থাকলে যা আমি প্রায়শই করে থাকি। লিফটের দরজা খুলে গেলো। ভেতরে সেই মহাশয় এখনও দাঁড়িয়ে আছেন এবং আমার ‘খুল যা সিম সিম’ টাইপ ভঙ্গি দেখে ফেলেছেন। আমি ভীষণ অপ্রস্তুতবোধ করলাম। ভেবেছিলাম উনি দশতলায় নেমে গেছেন। লিফটের ভেতর খালি, কেউ নেই।
 
“কী ব্যাপার? আপনি দশতলায় নামেননি?”
 
“দশতলায় কেন নামবো? আমি তো নিচে যাবো।”
 
“তাহলে উপরে গেলেন কেন?” আমি বেশ অবাক হলাম।
 
“আমি নিচে যাবার জন্য সেই চারতলায় লিফটে উঠেছি। তারপর থেকে লিফট নিচে না গিয়ে শুধু উপরের দিকে উঠছে আর প্রতি ফ্লোরে ফ্লোরে থামছে। দেখেন তো, সেই কতক্ষণ ধরে নিচে যেতে পারছি না। কারা যেন প্রতি তলাতেই লিফটের কল বাটনে চাপ দিয়ে রেখেছে।”
 
“আসলে এই বিল্ডিঙে কয়েকটা দুষ্টু বাচ্চা আছে। ওরা খেলার ছলে মজা করে প্রতি ফ্লোরে ফ্লোরে গিয়ে লিফটের কল বাটনে চাপ দিয়ে রাখে।”
 
এইটুকু বলেই আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। প্রচণ্ড জোরে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছি। হাসি আটকাতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো।
 
দুই.
বাসা বাড়ির লিফটগুলো মার্কেট কিংবা অফিসের লিফটগুলোর চাইতে আকারে অনেকটা ছোট হয়। ভেতরে যদিও আটজন ওঠার কথা লেখা থাকে, কিন্তু ছয়জন উঠলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। এমনই আরেকদিনের কথা।
 
আমিসহ চারজন ওঠার পর একদম শেষ মুহূর্তে স্কুলড্রেস পরা এক পিচ্চিকে নিয়ে একজন ভদ্রমহিলা লিফটে উঠলেন। লিফট পরিপূর্ণ। গরমে হাঁসফাঁস লাগছে। এমন সময় মনে হলো, কে যেন বিনা শব্দে পরিবেশ দূষণ করেছেন।
 
আমরা সুশীল নাগরিক। এসব বাজে ব্যাপার নিয়ে কথা বলে অভদ্রতা করি না। তাই সবার মুখে কুলুপ আঁটা। তবে একজন আরেকজনের মুখের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তাদের চোখের ভাষাগুলো অনুবাদ করা গেলে হয়তো অনেকটা এমন হতো।
 
“কী করে পারলেন?”
 
“মোটেও না। পাবলিক প্লেসে আমি এসব করি না।”
 
“আপনি আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? মেয়েরা লিফটে পাদ দেয় না। ওসব ছেলেদের কাজ! ছিঃ!”
 
“এ্যাই বেয়াদ্দপ ছোকরা। আমি কিছু করিনি। আমার দিকে তাকাবি না বলে দিচ্ছি!”
 
স্কুলের পিচ্চিটা তো আর এত কিছু বোঝে না। সে হঠাৎ মুখ ফসকে বলে বসলো, “আম্মু, কে জানি পাদ দিছে। হি হি হি!”
 
“এই চুপ! চুপ! দুষ্টু ছেলে কোথাকার। মারবো একটা।” ভদ্রমহিলা নিজের বাচ্চাকে সামলে নিয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে একটা হাসি দিলেন।
 
লিফট চারে আসতেই ভুঁড়িয়াল এক ভদ্রলোক নেমে গেলেন। দরজা খোলায় ভেতরের বাতাস বাইরে বের হলো, বাইরের বাতাস ভেতরে ঢুকলো। আহ, কী শান্তি!
 
এবার মেয়েটা আর বাচ্চাওয়ালী ভদ্রমহিলার মধ্যে চোখে চোখে কথা হচ্ছে।
 
“ওই ভুঁড়িয়াল ব্যাটাই মনে হয় আসল কালপ্রিট, তাই না?”
 
“হুম! আমারও তাই মনে হয়।”
 
মেয়েটা নেমে গেলো পাঁচে। বাকী রইলাম আমরা চারজন।
 
“আংকেল, পাদ পাদ খেলবেন?” বলে পিচ্চিটা মুখ দিয়ে পুত, পুত শব্দ করতে লাগলো।
 
“সরি ভাই। ওর কথায় কিছু মনে করবেন না।”
 
“না, না, আমি কিছু মনে করিনি।”
 
“অন্তু, আজ বাসায় চলো। তারপর তোমাকে লিফটে অভদ্রতা করার জন্য উচিৎ শিক্ষা দিবো।”
 
“আহা, থাক না! বাচ্চা মানুষ!”
 
পিচ্চিকে নিয়ে ভদ্রমহিলা নেমে গেলেন সাতে। বাকী রইলাম আমরা দু’জন।
 
“বোধহয় ওই ময়লা ন্যাকড়াটা থেকে গন্ধ আসছে।” ইঙ্গিতে লিফটের কোণায় পড়ে থাকা ন্যাকড়াটা দেখালেন লিফটের অপর ব্যক্তি।
 
“হুম! তাহলে এখন আর আসছে না কেন?” লিফট খালি, তাই উনার দিকে এবার ভালোমত খেয়াল করার সুযোগ হলো। অসম্ভব শুকনা শরীরের একজন মানুষ। তার ওপর আশির দশকের হিন্দি সিনেমার নায়ক জিতেন্দ্রর মত চিপা মোঁচ (সরু গোঁফ) রেখেছেন।
 
লিফট আটে চলে এসেছে। দরজা খোলার পর আমি নেমে পড়লাম। দু’এক পা সামনে এগোতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, পোঁ-ও-ও-ত। ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, জনাব জিতেন্দ্র সাহেব লিফটের দরজাটা দ্রুত বন্ধ করার জন্য প্রাণপণে >।< চিহ্ন সম্বলিত বাটনটা চেপে যাচ্ছেন।
 
 
রচনাকালঃ ৯ই অক্টোবর, ২০১৫

Tuesday, September 22, 2015

নেশা

 

এক.
 
“চল নেশা করি।”
 
“কী নেশা?” আরিফ কিছুটা আগ্রহ সহকারে জানতে চায়।
 
“গাঁজা, চরস, হেরোইন, বাবা, বোতল.. সব ধরণের আইটেমই পাওয়া যায়। তোর যেটা ভালো লাগবে, সেটা করবি। যাবি?”
 
“কখন যাবি?”
 
“সন্ধ্যার পর।”
 
“সন্ধ্যার পর হলে যেতে পারবো না, দোস্ত। বাবা মা দু’জনই তখন বাসায় থাকেন।”
 
“হাহ! তাদের এত সময় আছে নাকি তোর দিকে খেয়াল রাখার?”
 
“দেখ, আমার বাবা মা’কে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবি না।”
 
“আচ্ছা, আচ্ছা, বলবো না। এখন পাঁচশোটা টাকা ধার দে। সন্ধ্যায় লাগবে। আর যদি মত পাল্টাস, ফোন করে আমাকে জানাস।”
 
“মত পাল্টাবো না।” আরিফ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পাঁচশো টাকার একটা নোট সুজনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
 
আরিফের দেয়া টাকাটা চার ভাঁজ করে জিন্সের ছোট পকেটে ঢুকিয়ে রাখে সুজন। বড়লোকের একমাত্র সন্তান আরিফ। ওকে খুশী রাখতে পারলে চাইলেই টাকা ধার পাওয়া যায়। সেই ধার আর কখনই পরিশোধ করার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু এই একটা কারণেই আরিফের সঙ্গে বন্ধুত্বটা এখনও ধরে রেখেছে সুজন।
 
দুই.
আরিফ বাসায় ঢুকতেই বাবা মা’র গলার চড়া আওয়াজ ওর কানে ভেসে এলো।
 
“তোমার সাথে এভাবে আমার আর পোষাচ্ছে না।”
 
“তা পোষাবে কেন? তোমার তো এখন পুষিয়ে নেবার মত জায়গা অনেক।”
 
“একদম বাজে কথা বলবে না। আমি ওটা মিন করিনি।”
 
“তো কোনটা মিন করেছো?”
 
“থাক, ওসব নিয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাধে। দু’দিন পর পর বিজনেস ট্রিপগুলোতে গিয়ে তুমি যে কী করো, তা আমার জানা হয়ে গেছে!”
 
“ক্ক-কী জানো তুমি?”
 
“তোমার আগের সেক্রেটারি শারমিন চাকরী ছেড়ে চলে যাবার সময় আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে সব বলে দিয়ে গেছে।”
 
“শালী অকৃতজ্ঞ!” আরিফের বাবা তার সাবেক সেক্রেটারির উদ্দেশ্যে বাজে একটা গালি দেন।
 
“কনফারেন্সে যাবার নাম করে হোটেলের কামরায় নিয়ে তুমি ওর সর্বনাশ করোনি? এটা কীভাবে অস্বীকার করবে যে, তুমি ওর সম্ভ্রম নষ্ট করেছো?”
 
স্ত্রীর কাছে সব প্রকাশ হয়ে পড়ায় রাগে আরিফের বাবা তোতলাতে শুরু করেন।
 
পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে চলে আসে আরিফ। বাবা মা’র ঝগড়া আর শুনতে চাইছে না। নার্ভের ওপর ভীষণ চাপ পড়ে। প্রচণ্ড অস্থির লাগে। ইচ্ছে করে সব ভেঙে চুরমার করে দিতে। মরে যেতে ইচ্ছে হয়। মনের অস্থিরতা কাটাতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুজনকে ফোন দিলো আরিফ।
 
“হ্যালো। হ্যাঁ, আরিফ। বল।”
 
“কোথায় আসতে হবে?” আরিফ সরাসরি মূল কথায় চলে আসে।
 
“কেন? তুই যাবি আমাদের সাথে?”
 
“কোথায় আসতে হবে, সেটা বল।”
 
“তুই রহমান চাচার চায়ের দোকানে এসে বস। আমি তুহিন আর প্রিয়মকে সাথে নিয়ে ওখানে আসছি।”
 
“ওকে। আসছি আমি। বাই।”
 
“আর শোন। তুই গেলে আরও পাত্তি লাগবে। সঙ্গে আছে তো?”
 
“আছে।”
 
“গুড। তোর কাছে না থাকলে কী আর আমাদের কাছে থাকবে, বল? হাজার হোক, তুই বড়লোকের একমাত্র ছেলে।”
 
“রাখলাম। বাই।”
 
সুজনের এসব কথা শুনতে একেবারেই ভাল্লাগছে না আরিফের। তাই দ্রুত কথা শেষ করে কলটা কেটে দিলো।
 
আরিফ বড় রাস্তা ধরে রহমান চাচার চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সুজন, তুহিন, প্রিয়ম ওরা অনেক আগেই নষ্টের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আজ আরিফেরও নষ্ট হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
 
আরিফ চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। গোধূলি লগ্নে আকাশটা রক্তিম আকার ধারণ করেছে। আরিফের মনে হচ্ছে, ওর রক্তাত্ত হৃদয় থেকে চাপ চাপ রক্ত নিয়ে কেউ যেন আকাশটার গায়ে মাখিয়ে দিয়েছে। কাছের একটা মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের সুর কানে ভেসে এলো। আরিফ নিয়মিত নামাজ পড়লেও আজ ওর কানে যেন কিছুই ঢুকছে না।
 
আরিফ আজ নষ্টের খাতায় নাম লেখাবে। আজ ওর নষ্ট হয়ে যাবার দিন।
 
 
রচনাকালঃ ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫

Thursday, September 17, 2015

নামাজ

 
রাতে দুটো মুভি দেখা শেষ করে কানে হেডফোন লাগিয়ে শুয়ে শুয়ে ডাউনলোড করা নতুন গানগুলো শুনছে যায়ান। এমন সময় ফজরের আযান কানে ভেসে এলো। যায়ানদের বাসার খুব কাছেই মসজিদ। তাই কানে হেডফোন থাকা সত্ত্বেও আযানের সুর কানে এসে পৌঁছায়। কান থেকে হেডফোন খুলে মোবাইলে সময় দেখলো যায়ান। ওমা! রাতটা এত দ্রুত ফুরিয়ে গেলো? নাহ! এবার ঘুমাতে যাওয়া উচিৎ।
 
গানগুলো শোনার সময় মাথায় কিছু কথা ঘোরাফেরা করছিলো যায়ানের। শুতে যাবার আগে কথাগুলো লিখে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে মন চাইলো।
 
কথাগুলো লিখে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করার পর নিউজফিডটা শেষবারের মত স্ক্রল করছিলো যায়ান। এমন সময় বন্ধু তালিকার একজন ওর সদ্য পোস্ট করা স্ট্যাটাসটিতে একটা লাইক দিলো। ওর মতই জেগে ছিলো নাকি? যায়ান মনে মনে ভাবলো। বন্ধুটির সাথে এর আগে কখনো কথা হয়নি। আজ একটু কথা বলে দেখা যাক।
 
“আপনি ঘুম থেকে এত আর্লি ওঠেন?”
 
“নামাজ পড়তে উঠেছিলাম।”
 
“ও। তাহলে এখন আবার ঘুমাতে যাবেন?”
 
“হুম।”
 
“গুড মর্নিং, বাই দ্য ওয়ে।”
 
“শুভ সকাল।”
 
“আপনি ঘুম দিয়ে উঠলেন। আর আমি এখন ঘুমাতে যাবো।”
 
“ওমা! এখন? ইনসমনিয়া?”
 
“না, না, ইনসমনিয়া টাইপ কোনো সমস্যা নয়। এমনিতেই জেগে ছিলাম।”
 
“ও আচ্ছা। নামাজটা পড়ে নিন তাহলে।”
 
নামাজের কথা শুনে যায়ান লজ্জা পেয়ে যায়।
 
“আমি তো নামাজ পড়ি না।”
 
“কেন?”
 
“এমনিতেই পড়ি না।”
 
“আপনি ঈদের নামাজ পড়েন?”
 
কী ব্যাপার! যায়ান নামাজ পড়ার নিয়মকানুন জানে কিনা, তা পরখ করে দেখছে নাকি?
 
“হ্যাঁ, তা অবশ্য পড়ি।”
 
“ভাইয়া, আমি আপনার বয়সে অনেক ছোট হবো। তারপরও একটা কথা বলি, প্লিজ মাইন্ড করবেন না।”
 
“না, না, মাইন্ড করবো না। বলুন।”
 
“আপনি এখন নামাজটা পড়ে দেখুন। নামাজের ভেতর একটা ম্যাজিক্যাল ব্যাপার আছে। ইউ ক্যান ফিল ইট।”
 
“আমি জানি, নামাজ পড়লে হয়তো অনেক ভালো লাগবে!”
 
“ভালো লাগাটা শুধু একটু সময়ের জন্য না। পুরো দিনটার জন্য। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। প্লিজ?”
“ওকে, চেষ্টা করে দেখি।”
 
“থ্যাংক ইউ। থ্যাংকস আ লট।”
 
“আচ্ছা, নামাজ কাজা হয়ে যায়নি?” যায়ান শেষবারের মত এড়ানোর চেষ্টা করলো।
 
“না। এখন পড়লেও হবে।”
 
“ঠিক আছে। আজ যাই তাহলে, কেমন?”
 
“আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।”
 
বলে তো ফেলেছে, এখন কী করবে? নামাজ নিয়ে কোনো ধরণের মিথ্যার আশ্রয় নেয়াটা ঠিক হবে না। আচ্ছা, দেখাই যাক না। ওজুটা অন্তত করে আসা যাক।
 
ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালো যায়ান। দেখতে দেখতে দুই রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করাও হয়ে গেলো।
 
জায়নামাজ ভাঁজ করে বারান্দায় ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এসে দাঁড়ালো যায়ান। সত্যিই আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের চাইতে অন্যরকম লাগছে। নিজের ভেতর কীরকম যেন একটা প্রশান্তি বিরাজ করছে।
 
মেয়েটি আসলে ঠিকই বলেছে। এখন থেকে নামাজটা নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করবে, শুতে গিয়ে ভাবে যায়ান। মেয়েটিকে মন থেকে একটা ধন্যবাদ দিতে খুব ইচ্ছে করছে। কীভাবে দেয়া যায়, তা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
 
 
রচনাকালঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫

Sunday, September 13, 2015

সংগ্রাম


একটা গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে তমাল। ওর পুরো শরীরটা ঘামে ভিজে জব জব করছে। টিশার্টটা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। পানির জন্য বুকটা হাহাকার করছে। তমাল পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ হলো এই গলিটাতে এসে ঢুকেছে। এর আগে কখনো এদিকটায় আসা হয়নি। এখানকার রাস্তাঘাটও তেমন চেনে না সে।
 
চিনবে কী করে? সারাদিন বনানী ক্যাম্পাসে ক্লাস করে বিকেলে জ্যাম ঠেলে ধানমন্ডিতে দৌড়াতে হয়। ওখানে একটা বাচ্চাকে পড়ায়। সেখান থেকে খাবি খেতে খেতে চলে যায় বংশালে। দুটো টিউশনি শেষ করে লালবাগের মেসে যখন ফেরে, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত এগারোটার ঘর পেরিয়ে বারোটার দিকে ধাবমান।
 
মেসে রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটার ভেতর সবাই খেয়ে নেয়। তমাল রোজ দেরীতে ফেরে বলে ওর খাবারটা ঢেকে রাখা হয়। মেসের খালা একবেলা এসে দু’বেলার রান্না করে দিয়ে যান। দূপুরবেলার রান্না করা ভাত রাতে সবাই গরম করে নিয়ে খায়। তমালের খাবারটা কেউ গরম করে রাখে না। প্রায়ই ভাত থেকে গন্ধ বেরোয়। তার ওপর যেদিন মাছ রান্না করা হয়, সবাই পেটির পিসগুলো খেয়ে ওর জন্য লেজটা রেখে দেয়। মাংসের দাম অসম্ভব বেড়ে যাবার পর মাংস কালেভদ্রে আনা হয়। আর আনলেও তমালের ভাগে চর্বি আর হাড্ডি ছাড়া ভালো কিছু জোটে না। মুরগীর মাংস শেষ কবে খেয়েছে, তমালের মনে পড়ে না।
 
ঢাকায় আসার পর থেকে জীবন এভাবেই চলে আসছে। এসব নিয়ে তমালের কোনো আক্ষেপ নেই। ও শুধু চায় নিজের লেখাপড়াটা যেন ঠিকভাবে শেষ করতে পারে। তারপর ভালো একটা চাকরী নিয়ে গরীব বাবা মায়ের স্বপ্নটুকু পূরণ করবে।
 
সেই স্বপ্ন পূরণে আজ ওর.. না, না, শুধু ওর নয়, ওর মত আরও অনেক তমালের স্বপ্ন বাধার সম্মুখীন। এখন থেকে সেমেস্টার ফিয়ের ওপর নাকি ৭.৫% হারে ভ্যাট দিতে হবে।
 
স্কুল কলেজের শিক্ষকরা বাবা মাকে বলতেন, যত কষ্টই হোক তারা যেন তমালের পড়ালেখাটা চালিয়ে যান। বাবা মা’ও এক বুক আশা নিয়ে তমালকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছেন। কোথাও কোচিং না করায় আর সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি তমালের। বাবা তবু সাহস যুগিয়েছিলেন, ‘ফিরে আসিস না বাবা। প্রাইভেটে চেষ্টা কর। আমি যেভাবে পারি টাকা যোগাড় করবো।’
 
কয়েকটা সেমেস্টার যেতে না যেতেই তমালের বাবার পক্ষে টাকা যোগাড় করে পাঠানোটা কষ্টকর হয়ে পড়লো। সে সময়টাতে পরম করুণাময় আল্লাহ্‌তায়ালা ওদের দিকে মুখ তুলে চাইলেন। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তমাল দুটো টিউশনির খোঁজ পেলো। এখন বাবার ওপর চাপ অনেকখানি কমেছে। টিউশনি দুটোর বেতন দিয়ে নিজের পুরো মাসের খরচ চালিয়েও তা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সেমেস্টার ফি দেয়ার কাজে লাগায় তমাল।
 
কিন্তু এখন আবার ৭.৫% ভ্যাটের ঘোষণায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে তমালের। এমনিতেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সেমেস্টার ফি দিতে গিয়ে গলায় রক্ত উঠে যায়। আবার সেই টাকার ওপর ভ্যাট। শিক্ষার ওপর ভ্যাট কেন দিতে হবে? ভ্যাট নেয়ার কী আর কোনো খাত নেই? তাছাড়া ওরাই বা কেন দিতে যাবে? শিক্ষা কি রাষ্ট্রের কাছে ওদের অধিকার নয়?
 
আজ তাই নিজেদের অধিকার আদায়ে আর সবার সাথে পথে নেমেছে তমাল। ওরা সবাই শান্তিপূর্ণভাবেই সামনে এগোচ্ছিলো। হঠাৎ পুলিশ এসে ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে লাঠিচার্জ আরম্ভ করে। তখনই উপায় না দেখে দৌড়ে এই গলিটাতে এসে ঢুকেছে তমাল।
 
“কিরে, তুই এখানে?” হাঁফাতে হাঁফাতে রাজীব এসে জানতে চায়। “চল, আবার রাস্তায় চল। ওরা মারতে চাইলে মারুক। তবু আমরা এক পয়সাও ভ্যাট দেবো না। আমরা আমাদের দাবী থেকে একচুলও পেছাবো না।”
 
“ঠিক বলেছিস, চল।”
 
তমাল রাজীবের দিকে তাকিয়ে সম্মতির হাসি হাসে। ওরা দু’জন গলি থেকে বেরিয়ে রাজপথের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়।
 
 
রচনাকালঃ ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫

Tuesday, July 7, 2015

ইফতার কড়চা


রোজ রোজ ইফতারে এই গরীবিখানা- ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, আলুর চপ, শশা, খেজুর আর রুহ আফজার শরবত খাদ্যনালীটায় একদম অরুচি ধরিয়ে দিয়েছে। পরিপাকতন্ত্রও মাঝে মাঝে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে। পেট গুড়গুড় শব্দ করে বলে ওঠে, ‘হজম হমু না, পারলে ঠ্যাকা।’ তাই মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, এ মাসের বেতনটা হাতে পেলেই বড়লোকি মার্কা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওদের বড়লোকি সব ইফতার আইটেম কিনে বাসায় এনে সবাই মিলে মজা করে খাবো। মাসের হিসেব করা খরচা থেকে হয়তো বেশ কিছু টাকা খসে যাবে। তা না হয় যাক! অতশত ভেবে লাভ কী? জীবন তো একটাই। তাছাড়া বাঁচবোই বা আর ক’দিন? মরে যাবার আগে একটু ভালোমন্দ খেয়েই না হয় মরি।
 
যথারীতি বেতনটা হাতে পেয়ে অফিস শেষে গুলশান এলাকার নামীদামী একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকলাম। এত এত ইফতার আইটেম সাজিয়ে বসে আছে, অথচ কোনো সুগন্ধ নাকে ভেসে এলো না! আমাদের এলাকায় তো বিকেলবেলা ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসলে সুঘ্রাণে রোজদারদের রোজার অর্ধেক ছুটে যায় যায় অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভাবলাম, বোধহয় বড়লোকি খাবারে কোনো গন্ধটন্ধ থাকে না। হুম, এ কারণেই ওরা টয়লেটে গেলে ওদের ইয়ে থেকে আমাদের মত অমন গন্ধও ছোটে না!
 
“ওটার নাম কী ভাই?”
 
“ওটা স্যার? ম্যাশড পটেটো চপ।”
 
“এক পিসের দাম কত?”
 
“স্যার, একচুয়েলি আমরা তো ওভাবে আলাদা সেল করি না।”
 
“তারপরও একটু হিসেব কষে বলা যায় না?”
 
“অলমোস্ট হান্ড্রেড টাকা, স্যার।”
 
“এক পিসের দাম?” আমার চোখ কপালে উঠে যায় যায় অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়।
 
“ইয়েস স্যার।” লোকটার মুখের হাসিটা বড় অমায়িক। দেখতে ভালো লাগছে।
 
শালারা ডাকাতের চেয়েও বড় কিছু থাকলে সেটা, আমি মনে মনে ভাবি। আমাদের এলাকার আবুল মিয়ার দোকানে এক পিস আলুর চপের দাম বড়জোর তিন থেকে পাঁচ টাকার মত হবে।
 
“আচ্ছা। আর ওগুলো?”
 
“ওগুলো স্যার ম্যাশড লেনটিল উইথ অনিওন রিংস।”
 
“কী সব নাম বলেন! ওটা পেঁয়াজু না?”
 
“উম.. পেঁয়াজু? ইউ ক্যান সে দ্যাট।”
 
“ওগুলা কত করে পিস?”
 
“অলমোস্ট সেইম, স্যার।”
 
“এত দাম ক্যান? ওগুলা কি মাখন দিয়া ভাজছেন?”
 
লোকটার মুখে কোনো উত্তর নেই। ঠোঁটে এখনও সেই অমায়িক হাসিটা ধরে রেখেছে।
 
হুম, এগুলো ছোলা। আমি দেখেই চিনেছি। আল্লাহ্ই জানেন, এটার নাম না জানি আবার কী দিয়ে রেখেছে।
 
“ভাই, এটা ছোলা না?”
 
“ইয়েস স্যার। বাট, একদম ফাইন টিউন করা।”
 
ফাইন টিউন! এরা কী ছোলা খায়, না ছোলা দিয়ে গানবাজনা করে?
 
“আচ্ছা যাক, এটা কী হিসাবে বেচেন? কেজিতে, নাকি তোলায়?”
 
“আই বেগ ইয়োর পার্ডন, স্যার। আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
 
“আরে ভাই, না বুঝার কী আছে? আমি আপনাদের এখান থেকে ইফতার কিনতে আসছি।”
 
“স্যার আমাদের এখানে তো ইনডিভিজুয়াল কোনো ইফতার আইটেম সেল করা হয় না। তবে পবিত্র মাহে রামাদান উপলক্ষ্যে আমাদের এখানে স্পেশাল ইফতার+ডিনার বুফের আয়োজন করা হয়েছে। মেন্যুতে ১০১টি আইটেম থাকবে। প্রাইসটা খুব্বই চিপ, স্যার।”
 
“কত?”
 
“অনলি বিডিটি ১৮০০++. ১৫% ভ্যাট এক্সক্লুডেড।”
 
“দামের সাথে আবার ++ ক্যান? এইটার অর্থ কী?”
 
“ওটা স্যার, আপনি যদি সাথে ড্রিংক্স, কফি অথবা আইসক্রিম জাতীয় কিছু নেন, সেটার প্রাইসটা এ্যাড করা হবে।”
 
“বাহ, ভালো তো। তারমানে এই টাকায় আমি পুরা ফ্যামিলি নিয়া খাইতে আসতে পারবো?”
 
“আই বেগ ইয়োর পার্ডন, স্যার!”
 
“আপনি কথায় কথায় এত মাফ চান কেন?”
 
“আই মিন, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, স্যার।”
 
“মানে, এই টাকায় কি আমি বাসার সবাইকে এখানে নিয়ে এসে ইফতার করতে পারবো?”
 
“স্যার, ইট’স ১৮০০++ পার পারসন।”
 
ধ্যাত্তেরি! ১৮০০+(ভ্যাট)২৭০=২,০৭০ টাকা গাঁট থেকে খসিয়ে বাসার সবাইকে ফেলে একা একা তোদের এই ভিনদেশী নাম দেয়া বুট, বেগুনি আর পেঁয়াজু খেতে আসবো নাকি? রেগেমেগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। নিকুচি করি তোদের এসব বড়লোকি ইফতারের। বাসার কাছাকাছি এসে আবুল মিয়ার দোকান থেকে একশো পঞ্চাশ টাকার ইফতার কিনলাম। এতগুলো ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, জিলাপি আর ছোট এক বাটি হালিম।
 
অন্যদিন আবুল মিয়ার সাথে দুই একটা ফ্রি দেয়া নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ক্যাচাল করি। আজ ক্যাচাল না করে উদাস নয়নে আবুল মিয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আবুল মিয়ার মুখটা যে এত মায়াকাড়া, সেটা এর আগে কখনও চোখে পড়েনি কেন?
 
“ভাইজান, আইজকা যে আপনে ফিরি নেওনের লাইগ্যা জোরাজুরি করলেন না?”
 
“উম.. না, এমনি। আজ আর ফ্রি দিতে হবে না।”
 
“লাগবো না ক্যান? লন, আইজকা আপনে না চাওনে আমি নিজে থেইক্যাই কয়ডা ফিরি দিয়া দিছি।” বলে আবুল মিয়া আমার হাতে ইফতারের প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিলো।
 
ইফতারের প্যাকেটগুলো নেটের ব্যাগে ঝুলিয়ে আনমনে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথার ভেতর একটা কথাই বার বার ঘুরপাক খেতে লাগলো। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ষোল কোটির ওপরে। তাদের ভেতর কয়টা মানুষের মন এই আবুল মিয়ার মতন বড়?
 
 
রচনাকালঃ ৭ই জুলাই, ২০১৫