Sunday, September 13, 2015

সংগ্রাম


একটা গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে তমাল। ওর পুরো শরীরটা ঘামে ভিজে জব জব করছে। টিশার্টটা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। পানির জন্য বুকটা হাহাকার করছে। তমাল পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ হলো এই গলিটাতে এসে ঢুকেছে। এর আগে কখনো এদিকটায় আসা হয়নি। এখানকার রাস্তাঘাটও তেমন চেনে না সে।
 
চিনবে কী করে? সারাদিন বনানী ক্যাম্পাসে ক্লাস করে বিকেলে জ্যাম ঠেলে ধানমন্ডিতে দৌড়াতে হয়। ওখানে একটা বাচ্চাকে পড়ায়। সেখান থেকে খাবি খেতে খেতে চলে যায় বংশালে। দুটো টিউশনি শেষ করে লালবাগের মেসে যখন ফেরে, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত এগারোটার ঘর পেরিয়ে বারোটার দিকে ধাবমান।
 
মেসে রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটার ভেতর সবাই খেয়ে নেয়। তমাল রোজ দেরীতে ফেরে বলে ওর খাবারটা ঢেকে রাখা হয়। মেসের খালা একবেলা এসে দু’বেলার রান্না করে দিয়ে যান। দূপুরবেলার রান্না করা ভাত রাতে সবাই গরম করে নিয়ে খায়। তমালের খাবারটা কেউ গরম করে রাখে না। প্রায়ই ভাত থেকে গন্ধ বেরোয়। তার ওপর যেদিন মাছ রান্না করা হয়, সবাই পেটির পিসগুলো খেয়ে ওর জন্য লেজটা রেখে দেয়। মাংসের দাম অসম্ভব বেড়ে যাবার পর মাংস কালেভদ্রে আনা হয়। আর আনলেও তমালের ভাগে চর্বি আর হাড্ডি ছাড়া ভালো কিছু জোটে না। মুরগীর মাংস শেষ কবে খেয়েছে, তমালের মনে পড়ে না।
 
ঢাকায় আসার পর থেকে জীবন এভাবেই চলে আসছে। এসব নিয়ে তমালের কোনো আক্ষেপ নেই। ও শুধু চায় নিজের লেখাপড়াটা যেন ঠিকভাবে শেষ করতে পারে। তারপর ভালো একটা চাকরী নিয়ে গরীব বাবা মায়ের স্বপ্নটুকু পূরণ করবে।
 
সেই স্বপ্ন পূরণে আজ ওর.. না, না, শুধু ওর নয়, ওর মত আরও অনেক তমালের স্বপ্ন বাধার সম্মুখীন। এখন থেকে সেমেস্টার ফিয়ের ওপর নাকি ৭.৫% হারে ভ্যাট দিতে হবে।
 
স্কুল কলেজের শিক্ষকরা বাবা মাকে বলতেন, যত কষ্টই হোক তারা যেন তমালের পড়ালেখাটা চালিয়ে যান। বাবা মা’ও এক বুক আশা নিয়ে তমালকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছেন। কোথাও কোচিং না করায় আর সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি তমালের। বাবা তবু সাহস যুগিয়েছিলেন, ‘ফিরে আসিস না বাবা। প্রাইভেটে চেষ্টা কর। আমি যেভাবে পারি টাকা যোগাড় করবো।’
 
কয়েকটা সেমেস্টার যেতে না যেতেই তমালের বাবার পক্ষে টাকা যোগাড় করে পাঠানোটা কষ্টকর হয়ে পড়লো। সে সময়টাতে পরম করুণাময় আল্লাহ্‌তায়ালা ওদের দিকে মুখ তুলে চাইলেন। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তমাল দুটো টিউশনির খোঁজ পেলো। এখন বাবার ওপর চাপ অনেকখানি কমেছে। টিউশনি দুটোর বেতন দিয়ে নিজের পুরো মাসের খরচ চালিয়েও তা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সেমেস্টার ফি দেয়ার কাজে লাগায় তমাল।
 
কিন্তু এখন আবার ৭.৫% ভ্যাটের ঘোষণায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে তমালের। এমনিতেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সেমেস্টার ফি দিতে গিয়ে গলায় রক্ত উঠে যায়। আবার সেই টাকার ওপর ভ্যাট। শিক্ষার ওপর ভ্যাট কেন দিতে হবে? ভ্যাট নেয়ার কী আর কোনো খাত নেই? তাছাড়া ওরাই বা কেন দিতে যাবে? শিক্ষা কি রাষ্ট্রের কাছে ওদের অধিকার নয়?
 
আজ তাই নিজেদের অধিকার আদায়ে আর সবার সাথে পথে নেমেছে তমাল। ওরা সবাই শান্তিপূর্ণভাবেই সামনে এগোচ্ছিলো। হঠাৎ পুলিশ এসে ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে লাঠিচার্জ আরম্ভ করে। তখনই উপায় না দেখে দৌড়ে এই গলিটাতে এসে ঢুকেছে তমাল।
 
“কিরে, তুই এখানে?” হাঁফাতে হাঁফাতে রাজীব এসে জানতে চায়। “চল, আবার রাস্তায় চল। ওরা মারতে চাইলে মারুক। তবু আমরা এক পয়সাও ভ্যাট দেবো না। আমরা আমাদের দাবী থেকে একচুলও পেছাবো না।”
 
“ঠিক বলেছিস, চল।”
 
তমাল রাজীবের দিকে তাকিয়ে সম্মতির হাসি হাসে। ওরা দু’জন গলি থেকে বেরিয়ে রাজপথের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়।
 
 
রচনাকালঃ ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫

No comments:

Post a Comment