Tuesday, July 7, 2015

ইফতার কড়চা


রোজ রোজ ইফতারে এই গরীবিখানা- ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, আলুর চপ, শশা, খেজুর আর রুহ আফজার শরবত খাদ্যনালীটায় একদম অরুচি ধরিয়ে দিয়েছে। পরিপাকতন্ত্রও মাঝে মাঝে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে। পেট গুড়গুড় শব্দ করে বলে ওঠে, ‘হজম হমু না, পারলে ঠ্যাকা।’ তাই মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, এ মাসের বেতনটা হাতে পেলেই বড়লোকি মার্কা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওদের বড়লোকি সব ইফতার আইটেম কিনে বাসায় এনে সবাই মিলে মজা করে খাবো। মাসের হিসেব করা খরচা থেকে হয়তো বেশ কিছু টাকা খসে যাবে। তা না হয় যাক! অতশত ভেবে লাভ কী? জীবন তো একটাই। তাছাড়া বাঁচবোই বা আর ক’দিন? মরে যাবার আগে একটু ভালোমন্দ খেয়েই না হয় মরি।
 
যথারীতি বেতনটা হাতে পেয়ে অফিস শেষে গুলশান এলাকার নামীদামী একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকলাম। এত এত ইফতার আইটেম সাজিয়ে বসে আছে, অথচ কোনো সুগন্ধ নাকে ভেসে এলো না! আমাদের এলাকায় তো বিকেলবেলা ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসলে সুঘ্রাণে রোজদারদের রোজার অর্ধেক ছুটে যায় যায় অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভাবলাম, বোধহয় বড়লোকি খাবারে কোনো গন্ধটন্ধ থাকে না। হুম, এ কারণেই ওরা টয়লেটে গেলে ওদের ইয়ে থেকে আমাদের মত অমন গন্ধও ছোটে না!
 
“ওটার নাম কী ভাই?”
 
“ওটা স্যার? ম্যাশড পটেটো চপ।”
 
“এক পিসের দাম কত?”
 
“স্যার, একচুয়েলি আমরা তো ওভাবে আলাদা সেল করি না।”
 
“তারপরও একটু হিসেব কষে বলা যায় না?”
 
“অলমোস্ট হান্ড্রেড টাকা, স্যার।”
 
“এক পিসের দাম?” আমার চোখ কপালে উঠে যায় যায় অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়।
 
“ইয়েস স্যার।” লোকটার মুখের হাসিটা বড় অমায়িক। দেখতে ভালো লাগছে।
 
শালারা ডাকাতের চেয়েও বড় কিছু থাকলে সেটা, আমি মনে মনে ভাবি। আমাদের এলাকার আবুল মিয়ার দোকানে এক পিস আলুর চপের দাম বড়জোর তিন থেকে পাঁচ টাকার মত হবে।
 
“আচ্ছা। আর ওগুলো?”
 
“ওগুলো স্যার ম্যাশড লেনটিল উইথ অনিওন রিংস।”
 
“কী সব নাম বলেন! ওটা পেঁয়াজু না?”
 
“উম.. পেঁয়াজু? ইউ ক্যান সে দ্যাট।”
 
“ওগুলা কত করে পিস?”
 
“অলমোস্ট সেইম, স্যার।”
 
“এত দাম ক্যান? ওগুলা কি মাখন দিয়া ভাজছেন?”
 
লোকটার মুখে কোনো উত্তর নেই। ঠোঁটে এখনও সেই অমায়িক হাসিটা ধরে রেখেছে।
 
হুম, এগুলো ছোলা। আমি দেখেই চিনেছি। আল্লাহ্ই জানেন, এটার নাম না জানি আবার কী দিয়ে রেখেছে।
 
“ভাই, এটা ছোলা না?”
 
“ইয়েস স্যার। বাট, একদম ফাইন টিউন করা।”
 
ফাইন টিউন! এরা কী ছোলা খায়, না ছোলা দিয়ে গানবাজনা করে?
 
“আচ্ছা যাক, এটা কী হিসাবে বেচেন? কেজিতে, নাকি তোলায়?”
 
“আই বেগ ইয়োর পার্ডন, স্যার। আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
 
“আরে ভাই, না বুঝার কী আছে? আমি আপনাদের এখান থেকে ইফতার কিনতে আসছি।”
 
“স্যার আমাদের এখানে তো ইনডিভিজুয়াল কোনো ইফতার আইটেম সেল করা হয় না। তবে পবিত্র মাহে রামাদান উপলক্ষ্যে আমাদের এখানে স্পেশাল ইফতার+ডিনার বুফের আয়োজন করা হয়েছে। মেন্যুতে ১০১টি আইটেম থাকবে। প্রাইসটা খুব্বই চিপ, স্যার।”
 
“কত?”
 
“অনলি বিডিটি ১৮০০++. ১৫% ভ্যাট এক্সক্লুডেড।”
 
“দামের সাথে আবার ++ ক্যান? এইটার অর্থ কী?”
 
“ওটা স্যার, আপনি যদি সাথে ড্রিংক্স, কফি অথবা আইসক্রিম জাতীয় কিছু নেন, সেটার প্রাইসটা এ্যাড করা হবে।”
 
“বাহ, ভালো তো। তারমানে এই টাকায় আমি পুরা ফ্যামিলি নিয়া খাইতে আসতে পারবো?”
 
“আই বেগ ইয়োর পার্ডন, স্যার!”
 
“আপনি কথায় কথায় এত মাফ চান কেন?”
 
“আই মিন, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, স্যার।”
 
“মানে, এই টাকায় কি আমি বাসার সবাইকে এখানে নিয়ে এসে ইফতার করতে পারবো?”
 
“স্যার, ইট’স ১৮০০++ পার পারসন।”
 
ধ্যাত্তেরি! ১৮০০+(ভ্যাট)২৭০=২,০৭০ টাকা গাঁট থেকে খসিয়ে বাসার সবাইকে ফেলে একা একা তোদের এই ভিনদেশী নাম দেয়া বুট, বেগুনি আর পেঁয়াজু খেতে আসবো নাকি? রেগেমেগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। নিকুচি করি তোদের এসব বড়লোকি ইফতারের। বাসার কাছাকাছি এসে আবুল মিয়ার দোকান থেকে একশো পঞ্চাশ টাকার ইফতার কিনলাম। এতগুলো ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, জিলাপি আর ছোট এক বাটি হালিম।
 
অন্যদিন আবুল মিয়ার সাথে দুই একটা ফ্রি দেয়া নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ক্যাচাল করি। আজ ক্যাচাল না করে উদাস নয়নে আবুল মিয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আবুল মিয়ার মুখটা যে এত মায়াকাড়া, সেটা এর আগে কখনও চোখে পড়েনি কেন?
 
“ভাইজান, আইজকা যে আপনে ফিরি নেওনের লাইগ্যা জোরাজুরি করলেন না?”
 
“উম.. না, এমনি। আজ আর ফ্রি দিতে হবে না।”
 
“লাগবো না ক্যান? লন, আইজকা আপনে না চাওনে আমি নিজে থেইক্যাই কয়ডা ফিরি দিয়া দিছি।” বলে আবুল মিয়া আমার হাতে ইফতারের প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিলো।
 
ইফতারের প্যাকেটগুলো নেটের ব্যাগে ঝুলিয়ে আনমনে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথার ভেতর একটা কথাই বার বার ঘুরপাক খেতে লাগলো। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ষোল কোটির ওপরে। তাদের ভেতর কয়টা মানুষের মন এই আবুল মিয়ার মতন বড়?
 
 
রচনাকালঃ ৭ই জুলাই, ২০১৫